রানা প্লাজা ট্র্যাজেডিরেএক যুগ
অনলাইন রিপোর্ট
আজ ২৪ এপ্রিল। দেশের পোশাক শিল্পে এক শোকাবহ দিন। এই দিনে সাভারের রানা প্লাজা ধসে ১১৩৬ জন শ্রমিকের করুণ মৃত্যু হয়। আহত হন আরও কয়েক হাজার শ্রমিক। দিনটি ঘিরে নানান শ্রমিক সংগঠন আয়োজন করেছে নানা কর্মসূচি।
সেই দিন যা ঘটে ছিল
ঢাকা-আরিচা মহাসড়কের সাভার বাসস্ট্যান্ডের পাশে অবস্থিত রানা প্লাজায় থাকা পোশাক কারখানার শ্রমিকরা প্রতিদিনের মতো ওই দিন সকাল ৮টায় হাজির হন নিজ নিজ কর্মস্থলে। উৎপাদনও শুরু করেন নির্ধারিত সময়ে। হঠাৎ সাড়ে ৯টার দিকে বিকট শব্দ। আশপাশে উড়তে থাকে ধুলাবালি। ধসে পড়েছে সাভারের রানা প্লাজা। শুরু হয় আহত শ্রমিকদের আহাজারি। উদ্ধারে এগিয়ে আসেন স্থানীয়রা। পরে তাদের সঙ্গে যুক্ত হয় সেনাবাহিনী, নৌবাহিনী, ফায়ার সার্ভিস, আনসার, র্যাব ও পুলিশ সদস্যরা। চলে বিরতিহীন উদ্ধার অভিযান।
যা ছিল ভবনটিতে
রানা প্লাজার প্রথম তলায় ছিল বিভিন্ন দোকান, দ্বিতীয় তলায়ও ছিল দোকান আর ব্যাংক, তৃতীয় তলার নিউ ওয়েভ বটমস লিমিটেড, চতুর্থ ও পঞ্চম তলায় নিউ ওয়েভ স্টাইল লিমিটেড ও ফ্যানটম ট্যাক লিমিটেড, ষষ্ঠ ও সপ্তম তলায় ইথারটে লিমিটেড গার্মেন্টস।
হতাহতের সংখ্যা
রানা প্লাজা থেকে ১১৩৬ শ্রমিকের লাশ উদ্ধার করা হয়েছে। আর ২৪৩৮ শ্রমিককে আহত অবস্থায় উদ্ধার করা হয়। আহতদের মধ্যে অনেকেই পঙ্গুত্ব বরণ করেছেন। অনেকে আবার মানসিক রোগী হয়ে আছেন।
তৈরি হয়েছে শহীদ বেদী
নিহতদের প্রতি শ্রদ্ধা জানাতে রানা প্লাজা ধসের পর ২০১৩ সালের ২৪ মে বিভিন্ন শ্রমিক সংগঠনের নেতারা ধ্বংসস্তূপ রানা প্লাজার সামনে নির্মাণ করেন এক শহীদ বেদি। অস্থায়ী শহীদ বেদিটির নামকরণ করা হয় প্রতিবাদ-প্রতিরোধ। এ বেদিটিকে কেন্দ্র করে এখনও বিভিন্ন শ্রমিক সংগঠন চালিয়ে আসছে নানা আন্দোলন কর্মসূচি।
বর্তমান রানা প্লাজার চিত্র
অধিকাংশ ধ্বংসস্তূপই সরিয়ে নিয়ে ফেলা হয়েছে বংশাই নদীর পাড়ে। এখনও কংক্রিট ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে রানা প্লাজার ১৮ শতাংশ জমির ওপর। চারপাশটা কাঁটাতার ও টিনের বেড়া দিয়ে রেখেছিল জেলা প্রশাসক। সেটিও আর নেই। সামনেই বিভিন্ন সংগঠন তৈরি করেছে শহীদ বেদি। বছর পূর্তিতে রানা প্লাজায় আহত, নিহত আর স্বজনদের আনাগোনা চোখে পড়ে। বিভিন্ন শ্রমিক সংগঠন নানান দাবিতে এখানে আন্দোলন করেন।
সোহেল রানার সব ভূমি সরকারের দখলে
সোহেল রানার মালিকানাধীন রানা প্লাজার ভূমি, রানা টাওয়ারের ভূমি ও ধামরাইয়ের রানা ব্রিকসের ভূমি সরকারের দখলে রয়েছে। আদালতের নির্দেশে তার মালিকানাধীন সব ভূমি বাজেয়াপ্ত করে ঢাকার জেলা প্রশাসক দখল বুঝে নিয়েছে।
কালের সাক্ষী অধরচন্দ্র স্কুল মাঠ
বেদনার সাক্ষী হয়ে আছে সাভারের অধরচন্দ্র উচ্চ বিদ্যালয়ের মাঠ। ঘটনার দিন থেকে টানা ১৭ দিন ওই বিদ্যালয়ের মাঠে নিহতদের লাশ নিয়ে রাখা হতো। আর স্বজনদের কাছে হস্তান্তর করা হতো সেই মাঠ থেকে। প্রিয় মানুষটির সন্ধান পেতে স্বজনরা দিগ্বিদিক ছোটাছুটি করেছিলেন। রানা প্লাজা থেকে বিদ্যালয়ের মাঠ দেড় কিলোমিটারজুড়ে সে সময় অ্যাম্বুলেন্সের মুহুর্মুহু শব্দ সবাইকে জাগিয়ে তুলতো। আর অপেক্ষারত স্বজনরা হুমড়ি খেয়ে পড়তেন- এই বুঝি এলো তার স্বজন।
শ্রমিক নেতাদের দাবি
রানা প্লাজা ধসে পড়ার পর প্রায় প্রতিটি শ্রমিক সংগঠনই নড়েচড়ে বসে। শ্রমিকদের কর্ম পরিবেশ নিরাপদ রাখতে আন্দোলন শুরু করেন। নিহত ও আহতদের লস অব আর্নিংয়ের ভিত্তিতে ক্ষতিপূরণ দেওয়ার দাবিও করেন তারা। ২৪ এপ্রিলকে জাতীয় শোক দিবস ঘোষণা করার জোর দাবি জানান তোলেন তারা।
বাংলাদেশ গার্মেন্টস অ্যান্ড শিল্প শ্রমিক ফেডারেশনের সভাপতি রফিকুল ইসলাম সুজন বলেন, প্রতি বছর এই দিনে আমরা নিহতদের স্মরণে বিভিন্ন কর্মসূচি পালন করি। প্রতি বছরই আমরা একই দাবি তুলে ধরি, রানা প্লাজার অনেক শ্রমিক রয়েছেন যারা এখনও ক্ষতিপূরণ পায়নি। দ্রুত ওই সব শ্রমিকদের লস অব আর্নিংয়ের ভিত্তিতে ক্ষতিপূরণ প্রদান করতে হবে। এ ছাড়া সরকার সোহেল রানার যে সব সম্পত্তি জব্দ করেছে সেসব নিহত ও আহত পরিবারের মাঝে বিলিয়ে দিতে হবে। আমাদের দীর্ঘদিনের দাবির কোনোটাই বাস্তবায়ন করা হয়নি। আমরা আশা করি অন্তর্বর্তীকালীন সরকার আমাদের দাবিগুলো পূরণ করবে। ভবন মালিক সোহেল রানাসহ দোষীদের সর্বোচ্চ শাস্তি নিশ্চিত করবে।
এমনটি নাও হতে পারতো
এ ঘটনার জন্য সে সময় স্থানীয় প্রশাসনের গাফেলতিকেই দায়ী করছিল স্থানীয় সুশীল সমাজ ও আহত শ্রমিকরা। তাদের দাবি ছিল, ভবনটি ধসের ঠিক ২৪ ঘণ্টা আগেই ফাটল দেখা দিয়েছিল ৪ ও ৫ তলার কয়েকটি পিলারে। যা দেখে শ্রমিকরা কর্মস্থল থেকে নেমে আসেন মহাসড়কে। এমন সংবাদের পর সেখানে ছুটে যান স্থানীয় সংবাদকর্মীরা। তবে সংবাদকর্মীদের ওই স্থানে প্রবেশ করতে দেয়নি মালিক কর্তৃপক্ষ । এ সময় সংবাদকর্মীরা যোগাযোগ করেন স্থানীয় প্রশাসনের বিভিন্ন কর্মকর্তাদের কাছে। সংবাদ প্রচার হয় বিভিন্ন প্রিন্ট ও ইলেকট্রনিল মিডিয়ায়।
পরে ওই দিন বিকালেই ভবনের ফাটল দেখতে আসেন তৎকালীন উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা কবির হোসেন সরদার। তিনি এসে ভবনটির কয়েক ব্যবসায়ী ও শ্রমিক প্রতিনিধিদের আশ্বস্ত করে বলেন, ‘এ ফাটলে তেমন কোনও সমস্যা নেই, বড় ধরনের দুর্ঘটনার আশঙ্কা নেই। সামান্য প্লাস্টার উঠে গেছে। সব ঠিক হয়ে যাবে।’ এ বলে তিনি চলে যান।
তার এ বক্তব্যের ২৪ ঘণ্টা না পেরোতেই ভবনটিতে ঘটলো দেশের ইতিহাসের সবচেয়ে বড় ভবন ধসে হতাহতের ঘটনা। নিভে গেলো হাজারের বেশি জীবন প্রদীপ। সে সময় পদক্ষেপ নিলে এমন ঘটনা নাও হতে পারতো। অবশ্য এ ঘটনায় তৎকালীন উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা কবির হোসেন সরদারকে দায়িত্ব থেকে সরিয়ে দেওয়া হয়।
https://jarinmedia.com/news/national/1f020c79-0e7d-6aa0-b443-e655c3f842f9